আবদুর রহমান, টেকনাফ::
বিশ্বের বৃহত্তম শরণার্থী অধ্যুষিত জনপদ কক্সবাজার। এ জেলায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে বাস করে। ব্যাপক জনঘনত্বের এই শিবিরে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটলে তার পরিণাম ভয়াবহ হওয়ার আশঙ্কা করছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, রোহিঙ্গা ও সেবা সংস্থার প্রতিনিধিরা। তারা বলছেন, রোহিঙ্গাদের বেশির ভাগই অসচেতন। বিদেশ সফর শেষে একাধিক ব্যক্তি ‘হোম কোয়ারেন্টিনে’ না থেকে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এ নিয়ে শিবিরের মানুষজনের মধ্যে কাজ করছে উৎকণ্ঠা। তবে কর্তৃপক্ষ বলছে, করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে রোহিঙ্গাদের সচেতন করা হচ্ছে।
টেকনাফ হ্নীলা ইউপি চেয়ারম্যান রাশেদ মোহাম্মদ আলী তার এলাকাকে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে দেখছেন। তিনি বলেন, ‘এখানে আশ্রিত রোহিঙ্গারা মাঝে-মধ্যে মিয়ানমার পারাপার করে থাকে। তাছাড়া মিয়ানমারের সঙ্গে চীনের সীমান্ত রয়েছে, আর রোহিঙ্গারা চোরাপথে মিয়ানমারে আসা-যাওয়া করে। সেজন্য আমাদের ঝুঁকিটা অনেক বেশি।’ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বেশি নজরদারির দাবি জানান তিনি।
শরণার্থী রোহিঙ্গাদের সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের নেতা সৈয়দ উল্লাহ বলেন, ইতোমধ্যে বাংলাদেশে একাধিক ব্যক্তির করোনা আক্রান্তের খবরে তাদের মধ্যে ভয় বেড়েছে। কারণ, শিবিরে ঘিঞ্জি বসতি, সেহেতু ঝুঁকিটাও বেশি।
তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি শিবিরে বিদেশ সফর শেষে এক রোহিঙ্গা নারী এসেছেন। তিনি এলাকায় ঘোরাঘুরি করছেন। তার কোনও পরীক্ষা করা হয়নি। এখন পর্যন্ত সরকার ও এনজিও সংস্থার পক্ষ থেকে করোনাসংক্রান্ত কোনও কার্যক্রম হয়নি। কীভাবে এই ভাইরাস থেকে নিজেকে রক্ষা করা যায়, সেটি অনেকে জানেন না।’ তিনি এ ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান।
আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেনও গত বুধবার (১৮ মার্চ) তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা করোনা ভাইরাস নিয়ে উৎকণ্ঠায় রয়েছে বলে সতর্ক করেছে।
রোহিঙ্গা শিবিরে তাপমাত্রা পরীক্ষা করা হচ্ছে
রোহিঙ্গা শিবিরে তাপমাত্রা পরীক্ষা করা হচ্ছে
তবে কক্সবাজারের সিভিল সার্জন ডা. মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘এখন পর্যন্ত শিবিরের কারোর মধ্যে করোনা ভাইরাসের কোনও লক্ষণ পাওয়া যায়নি। তবে তেমনটা দেখা গেলে রক্ত সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (আইইডিসিআর) পাঠানোর প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘কেউ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে তাকে আলাদা করে রাখার জন্য শরণার্থী শিবিরের স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোয় ইতোমধ্যে ৪৭টি এবং রামু ও চকরিয়া উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ১০০টি শয্যা প্রস্তুত করা হয়েছে।
শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের প্রতিনিধি ও টেকনাফ নিবন্ধিত নয়াপাড়া ও লেদা রোহিঙ্গা শিবিরের কর্মকর্তা আবদুল হান্নান বলেন, ‘রোহিঙ্গারা এই ভাইরাস থেকে কীভাবে নিজেদের রক্ষা করবে, সেটি বলছেন চিকিৎসকরা। যদি কারো জ্বর, সর্দি ও কাশি দেখা যায় সঙ্গে সঙ্গে শিবিরের স্বাস্থ্য বিভাগে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে।
করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে শিবিরের মানুষজনকে সচেতন করা হচ্ছে বলে উল্লেখ করে টেকনাফ লেদা শরণার্থী শিবিরের ডেভেলপমেন্ট কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ আলম বলেন, ‘করোনা ভাইরাস থেকে রক্ষায় হাত ধোয়াসহ বিভিন্ন ধরনের সচেতনতামূলক কার্যক্রম করতে বলা হচ্ছে। পাশাপাশি শিবিরে যাতে কোনও লোকসমাগম না হয় সেদিকে নজর রাখা হচ্ছে। তাছাড়া দুই দিন আগে তার শিবিরে এক এনজিও সংস্থার পক্ষ থেকে থার্মাল প্লাস দিয়ে কিছু রোহিঙ্গার পরীক্ষা করা হয়েছিল।
টেকনাফ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. টিটু চন্দ্র শীল বলেন, ‘রোহিঙ্গারা অবৈধপথে মিয়ানমারসহ বিভিন্ন দেশে পারাপার করে থাকে। সীমান্ত ও উপকূল দিয়ে এসব রোহিঙ্গা এখানে ঢুকে পড়লে ঝুঁকিটা অনেক বেড়ে যাবে। তাই অবৈধভাবে কেউ ঢুকতে না পারে সেদিকে নজরদারি বাড়াতে হবে। তাছাড়া যেহেতু করোনা ছোঁয়াচে আর শরণার্থী শিবিরগুলোও ঘনবসতিপূর্ণ, তাই রোহিঙ্গা শিবিরে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ মাহবুব আলম তালুকদার বলেন, “রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ‘আইসোলেশান ইউনিট’ হিসাবে দেড়শটি শয্যা প্রস্তুতের কাজ চলছে। সংক্রমণ মোকাবিলায় বিভিন্ন সংস্থার ২৮০ জন ডাক্তার, নার্স ও স্বেচ্ছাসেবককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘শরণার্থীদের স্বাস্থ্য ও ভালো থাকার বিষয়টিকে আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে থাকি, যদিও শিবিরগুলোয় এখনও কোভিড-১৯ সম্পর্কিত কোনও সন্দেহজনক ঘটনা পাওয়া যায়নি। তবু বর্তমান পরিস্থিতিতে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে ইউএনএইচসিআর। পাশাপাশি সংক্রমণ ঠেকাতে বিদেশি পরিদর্শকদের রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। নতুন করে আসা বিদেশিদের ক্যাম্পে প্রবেশ একদম বন্ধ করা হয়েছে।
উখিয়া উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ নিকারুজ্জামান চৌধুরী বলেন, ‘বিদেশ সফর শেষে এক রোহিঙ্গা উখিয়া কুতুপালং ক্যাম্পে স্বজনের কাছে চলে আসেন। খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাকে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্য নিয়ে আসা হয়েছে। তাছাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আইসোলেশন সেন্টার রয়েছে। বিদেশফেরত কেউ ক্যাম্পে আশ্রয় নিলে প্রশাসনকে অবহিত করতে বলা হয়েছে ক্যাম্পের মাঝিদের।
পাঠকের মতামত: